ফোর্বস ম্যাগাজিনের হিসাবে, গত সপ্তাহে তাঁর সম্পদ কমেছে তিন হাজার ১০০ কোটি ডলার বা ২৪ শতাংশ। সপ্তাহের শুরুতে তাঁর সম্পদ ছিল ১২ হাজার ৭৮০ কোটি ডলার। আর সপ্তাহ শেষে গত শুক্রবার তাঁর সম্পদ কমে হলো ৯ হাজার ৬৬০ কোটি ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শেয়ারবাজার বিশ্লেষক সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ আদানি গ্রুপের শেয়ারবাজার কারসাজি, অর্থপাচার আর কর ফাঁকি নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই তাঁর পতন শুরু। প্রতিবেদন প্রকাশের পরবর্তী তিন দিনে আদানি এন্টারপ্রাইজের শেয়ারের দাম প্রায় ২০ শতাংশ কমে গেছে। মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের তালিকায় এত দিন বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধনী ব্যক্তি হিসেবে নাম ছিল গৌতম আদানির। তবে সাম্প্রতিক এই ধসের পর সেই তালিকায় তিনি সপ্তম স্থানে নেমে গেছেন।
আদানি গ্রুপের কম্পানিগুলোর মধ্যে আদানি পোর্ট, আদানি গ্রিন ও আদানি টোটাল গ্যাসের শেয়ারদর কমেছে ২০ শতাংশ, আর আম্বুজা সিমেন্টের দর কমেছে ২৫ শতাংশ। আদানি পাওয়ার, আদানি উইলমার ও এনডিটিভির শেয়ারদর সর্বনিম্ন সীমায় নেমে আসে। এ ছাড়া গত শুক্রবার যে আদানি এন্টারপ্রাইজের এফপিও বাজারে এসেছে, তার মূল্যও ১৮.৫ শতাংশ কমেছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, সবচেয়ে বেশি দর কমেছে ব্যাংকের শেয়ারের। দরপতনের কারণ হলো দেশটির বেশ কিছু ব্যাংক, যেমন—এসবিআই, ব্যাংক অব বারোদা, পিএনবি ও আইসিআইসিআই ব্যাংক থেকে আদানি গ্রুপের মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নেওয়ার কারণে ব্যাংক খাত নিয়েই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, অর্থাৎ আদানি গ্রুপ এসব ঋণ পরিশোধ করতে পারবে কি না তা নিয়ে। ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যাংকিং স্টক নিফটি ব্যাংক সূচকের পতন হয়েছে ৩ শতাংশের বেশি।
এতে আরো বলা হয়েছে, কম্পানিতে প্রমোটর বা মালিকের কারসাজির ফলেই স্টকের দাম বাজারে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। আদানিরা অন্য লোকের ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচুর শেয়ার কিনে নিজের শেয়ারের দাম বাড়িয়েছে, যা এককথায় বিনিয়োগকারীদের চোখে ধুলা দেওয়ারই নামান্তর। এ ধরনের জালিয়াতির তালিকায় নাম রয়েছে আদানির পাঁচ কম্পানির।
একই সঙ্গে হিন্ডেনবার্গ জালিয়াতির অভিযোগও এনেছে। তারা বলেছে, মরিশাস, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো যেসব দেশে আয়কর ছাড়ের সুবিধা আছে, সে রকম কিছু দেশে আদানি পরিবারের মালিকানাধীন ভুয়া কম্পানি আছে। সেগুলোর মাধ্যমে বেআইনি লেনদেন, কর ফাঁকি ও আইন ভেঙে নথিভুক্ত সংস্থা থেকে অন্যত্র অর্থ সরিয়েছে তারা। আদানি গ্রুপের ঘটনায় চাপের মধ্যে রয়েছে নিফটি ও সেনসেক্স সূচক। ফলে আগামী সপ্তাহেও দরপতন দেখা যেতে পারে ভারতের শেয়ারবাজারে।
এদিকে ভারতের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রকরা হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদনটি পড়ে দেখছেন। তাঁরা মূলত আদানি গ্রুপের অফশোর ফান্ড হোল্ডিংয়ের বিষয়টি ঘিরে তদন্ত চালাচ্ছেন। তাই হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদনটি তাঁদের চলমান তদন্তে সহায়তা করার জন্য ব্যবহার করা হতে পারে বলেও জানায় অন্য দুটি সূত্র। নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিংবা আদানির মুখপাত্রদের মধ্যে কেউ এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক মন্তব্য করেননি।
আদানি গ্রুপ অবশ্য হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদনকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়ে বলেছে নিউ ইয়র্কভিত্তিক সংস্থার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না তা বিবেচনা করা হচ্ছে। যদিও তারা ভারতের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রকদের পদক্ষেপের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
আদানি কি পারবেন চাপ সামলে উঠতে : গৌতম আদানি স্কুল থেকে ঝরে পড়া এক বিলিয়নেয়ার। ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটের বাসিন্দা তিনি। একজন ভোগ্য পণ্য ব্যবসায়ী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও এখন গড়ে তুলেছেন ব্যবসার বিশাল সাম্রাজ্য। তাঁর ব্যাবসায়িক আগ্রহের জায়গায় রয়েছে বন্দর, বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিমানবন্দর, খনি, ভোজ্য তেল, পুনর্নবায়নযোগ্য জ্বালানি আর সম্প্রতি গণমাধ্যম ও সিমেন্টের মতো খাত।
নজিরবিহীন শেয়ার মূল্যের ঘাটতি কিভাবে মোকাবেলা করা যায়, সেটাই এখন আদানির মূল চ্যালেঞ্জ। কারণ এই গোষ্ঠীর ফ্ল্যাগশিপ প্রতিষ্ঠান আদানি এন্টারপ্রাইজেস চলতি সপ্তাহে ভারতের বৃহত্তম পাবলিক সেকেন্ডারি শেয়ারের সূচনা করেছে, যার লক্ষ্য আড়াই বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা। শুক্রবার আদানির শেয়ারের দাম অফার মূল্যের চেয়ে অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় এর সাফল্য নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
তবে বিতর্কের জন্য আদানি যে একেবারে অপরিচিত, বিষয়টি তেমন নয়। কিছুদিন আগে দক্ষিণ ভারতের কেরালায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বন্দর নির্মাণের বিরুদ্ধে সেখানকার জেলেদের টানা কয়েক মাসের প্রতিবাদ এর সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ। দেশটির প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেহ প্রায়ই আদানি ও অন্য ধনীদের বিরুদ্ধে মোদি সরকারের কাছ থেকে ব্যাবসায়িক নীতিগত সুবিধা পাওয়ার বিষয় নিয়ে অভিযোগ করে আসছে।
প্রসঙ্গত, ভারতের ঝাড়খণ্ডে নির্মীয়মাণ আদানির বিদ্যুেকন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আগামী মার্চ থেকে এ আমদানি শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আনার জন্য স্বতন্ত্র সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজও সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশের ভোজ্য তেল খাতে আদানি গ্রুপের বিনিয়োগ রয়েছে। দেশের ভোজ্য তেলের বাজারে বিনিয়োগ আছে আদানি গ্রুপের। ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেডে (বিইওএল) (রূপচাঁদা, ফরচুন, কিংস, মিজান ও ভিওলা) সিঙ্গাপুরের উইলমার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ও আদানি গ্রুপ মিলে আদানি উইলমার নামে এ যৌথ উদ্যোগ গড়ে তোলে।
এ ছাড়া চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বিশেষ জোন নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছে আদানি গ্রুপ। বাংলাদেশেও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানটি। সূত্র : বিবিসি, এএফপি, রয়টার্স