ঢাকা , শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আগুনে পুড়ে মৃত্যুর যে দৃশ্য দেখে কেঁদেছেন মানুষ

  • পোষ্ট হয়েছে : ১১:০৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৬ জানুয়ারী ২০২৪
  • / ৪৫ বার দেখা হয়েছে

রাজধানীর গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুনে জানালায় দুই হাত বাইরে থাকা অবস্থায় এক ব্যক্তির পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য ছুঁয়ে গেছে মানুষকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিটি ভাইরাল হয়েছে। সেই ব্যক্তিকে উদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন স্থানীয়রা। কিন্তু তার (পুড়ে যাওয়া ব্যক্তি) স্ত্রী ও সন্তান পুড়ে যাওয়ার পর ‘বের হয়ে কী হবে?’ বলেছিলেন বলে জানান গোপীবাগ এলাকার বাসিন্দা মাসুদ রানা।

শুক্রবার রাতে যশোরের বেনাপোল থেকে ঢাকায় আসা বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটি তার গন্তব্যস্থল কমলাপুর পৌঁছার কিলোমিটার দুয়েক আগে থেমে যেতে বাধ্য হয়। দুর্বৃত্তদের আগুনে ট্রেনটির চারটি বগি পুড়ে যায়। বগি চারটি থেকে চারজনের মরদেহ উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

বেনাপোল থেকে যাত্রীবোঝাই করে ঢাকায় ফিরছিল ট্রেনটি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ গোপীবাগে আগুন দেখতে পান যাত্রীরা। চলন্ত অবস্থায় হুড়োহুড়ি করে নামতে থাকেন যাত্রীরা। আগুন লাগার সংবাদ পেয়ে ট্রেনচালক ট্রেনটি থামিয়ে দেন। এ সময় বেশিরভাগ যাত্রী নামতে পারলেও কিছু যাত্রী আগুনের ভয়াবহতায় নামতে পারেননি। তারা আগুনে নিঃশেষ হয়ে যান। এখন পর্যন্ত চারজন যাত্রীর মরদেহ উদ্ধারের খবর জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স।

মেহেরপুরের দর্শনা স্টেশন থেকে ট্রেনে সপরিবারে ঢাকায় ফিরছিলেন আশরাফুল। আগামী ৯ জানুয়ারি দুবাইয়ের ফ্লাইট ছিল তার। তবে এই যাত্রা আর হচ্ছে না। সবকিছু পুড়ে গেলেও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরাপদে বের হতে পেরেছেন তিনি।

আশরাফুল জাগো নিউজকে বলেন, পরিবারসহ বেনাপোল এক্সপ্রেসের ‘ছ’ বগিতে ছিলাম। হঠাৎ আগুন আগুন বলে চিৎকার এরপর ধোঁয়ায় কিচ্ছু দেখা যাচ্ছিল না। আমার ছোট বাচ্চাডাকে জানালা দিয়ে কোনোরকম ফেলে দিয়েছিলাম। নিচে এক লোক ক্যাচ ধরে ফেলায় বেঁচে গেছে বাচ্চা।

তিনি বলেন, পরে আমার স্ত্রী ও আরেক ছেলে অনেক কষ্ট করে বের হয়েছে। আমি জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। আগুনে আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি।

আশরাফুল আরও বলেন, আগুনে আমার পাসপোর্ট, টিকিট, নগদ ৫০ হাজার টাকা এবং লাগেজ ট্রেনের ভেতরেই ছিল। পুড়ে গেছে। কিছুই বাঁচাতে পারিনি। বিদেশযাত্রা বাতিল হলেও পরিবারকে রক্ষা করতে পেরেছি।

লালমাটিয়া গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক এস এম জয় জানান, তিনি স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতা থেকে আসছিলেন। তারাও ‘ছ’ বগিতে ছিলেন। ট্রেনটি সায়েদাবাদ ছাড়ার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ থেমে যায়। তারা ভেবেছিলাম স্টেশনে পৌঁছেছেন। কিন্তু হঠাৎ আগুন দেখে ভয় পেয়ে যান। সমস্ত লাগেজ রেখে ট্রেন থেকে লাফ দেন তারা।

কুষ্টিয়ার পোড়াদহ থেকে ঢাকায় আসছিলেন তানিয়া। হঠাৎ ট্রেনটিতে আগুন লেগে গেলে দুই মেয়েকে নিয়ে ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেন তিনি। ঘটনাস্থলে যখন তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখনো ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব ছিলেন তিনি।

তানিয়া বলেন, সবাই বলছিল যে, এটা গ্যাস থেকে শুরু হয়েছে। হৈচৈ হচ্ছিল। কেউ চেইন টেনে ট্রেন থামিয়ে দিলো। আমি দুই মেয়েসহ ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিলাম।

‘আমার ছেলে আসিফ তার স্ত্রী নাতাশাকে নিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকায় আত্মীয়র বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার পথে ঘটনার শিকার হয়। আগুন লাগার পর দরজা দিয়ে বের হতে না পেরে আসিফ জানালা দিয়ে মাথা বের করে। সে সময়ে লোকজন তাকে টেনে বের করতে পারলেও তার স্ত্রী নাতাশা বের হতে পারেনি। ধারণা করা হচ্ছে, নাতাশা ট্রেনেই রয়ে গেছে। আমরা এখনো নাতাশাকে খুঁজে পাইনি।’

হতাশাভরা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আবু সিদ্দিক খান। শোকগ্রস্ত এই বাবা জানান, গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডে তার ছেলে আসিফ খান (৩০) দগ্ধ হয়েছেন। নিখোঁজ পুত্রবধূর নাম নাতাশা জেসমিন। তাদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় এবং বর্তমানে রাজধানীর গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা।

শুক্রবার রাত ১০টার দিকে দগ্ধ অবস্থায় আসিফকে উদ্ধার করে শেখ হাসিনার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. তরিকুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ট্রেনে দগ্ধ একজন আমাদের জরুরি বিভাগে এসেছেন। তার শরীরের আট শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। জরুরি বিভাগে তার চিকিৎসা চলছে।

বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুনের ঘটনায় নিহত চারজনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। চার মরদেহের মধ্যে একজন নারী ও একজন শিশু। বাকি দুজনের মরদেহ এতটাই বিকৃত হয়ে গেছে যে শনাক্ত করা যায়নি। স্বজনরা তাদের পরিজন দাবি করলেও মরদেহ দেখে শনাক্ত করতে পারছেন না।

ঢাকা রেলওয়ে থানার (কমলাপুর) উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. সেতাফুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘চারটি মরদেহের মধ্যে দুজন নারী ও শিশু। বাকি দুজন নারী না পুরুষ বোঝা যাচ্ছে না। নাতাশা জেসমিন (২৫) ও এলিনা ইয়াসমিন (৩০) নামে দুই নারীর মরদেহ দাবি করে তাদের স্বজনরা এসেছেন। তারা মরদেহ দেখেও শনাক্ত করতে পারেননি। ডিএনএ টেস্ট করে শনাক্ত করা হবে।’

ট্যাগ :

শেয়ার দিয়ে সাথেই থাকুন

আগুনে পুড়ে মৃত্যুর যে দৃশ্য দেখে কেঁদেছেন মানুষ

পোষ্ট হয়েছে : ১১:০৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৬ জানুয়ারী ২০২৪

রাজধানীর গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুনে জানালায় দুই হাত বাইরে থাকা অবস্থায় এক ব্যক্তির পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য ছুঁয়ে গেছে মানুষকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিটি ভাইরাল হয়েছে। সেই ব্যক্তিকে উদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন স্থানীয়রা। কিন্তু তার (পুড়ে যাওয়া ব্যক্তি) স্ত্রী ও সন্তান পুড়ে যাওয়ার পর ‘বের হয়ে কী হবে?’ বলেছিলেন বলে জানান গোপীবাগ এলাকার বাসিন্দা মাসুদ রানা।

শুক্রবার রাতে যশোরের বেনাপোল থেকে ঢাকায় আসা বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটি তার গন্তব্যস্থল কমলাপুর পৌঁছার কিলোমিটার দুয়েক আগে থেমে যেতে বাধ্য হয়। দুর্বৃত্তদের আগুনে ট্রেনটির চারটি বগি পুড়ে যায়। বগি চারটি থেকে চারজনের মরদেহ উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

বেনাপোল থেকে যাত্রীবোঝাই করে ঢাকায় ফিরছিল ট্রেনটি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ গোপীবাগে আগুন দেখতে পান যাত্রীরা। চলন্ত অবস্থায় হুড়োহুড়ি করে নামতে থাকেন যাত্রীরা। আগুন লাগার সংবাদ পেয়ে ট্রেনচালক ট্রেনটি থামিয়ে দেন। এ সময় বেশিরভাগ যাত্রী নামতে পারলেও কিছু যাত্রী আগুনের ভয়াবহতায় নামতে পারেননি। তারা আগুনে নিঃশেষ হয়ে যান। এখন পর্যন্ত চারজন যাত্রীর মরদেহ উদ্ধারের খবর জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স।

মেহেরপুরের দর্শনা স্টেশন থেকে ট্রেনে সপরিবারে ঢাকায় ফিরছিলেন আশরাফুল। আগামী ৯ জানুয়ারি দুবাইয়ের ফ্লাইট ছিল তার। তবে এই যাত্রা আর হচ্ছে না। সবকিছু পুড়ে গেলেও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরাপদে বের হতে পেরেছেন তিনি।

আশরাফুল জাগো নিউজকে বলেন, পরিবারসহ বেনাপোল এক্সপ্রেসের ‘ছ’ বগিতে ছিলাম। হঠাৎ আগুন আগুন বলে চিৎকার এরপর ধোঁয়ায় কিচ্ছু দেখা যাচ্ছিল না। আমার ছোট বাচ্চাডাকে জানালা দিয়ে কোনোরকম ফেলে দিয়েছিলাম। নিচে এক লোক ক্যাচ ধরে ফেলায় বেঁচে গেছে বাচ্চা।

তিনি বলেন, পরে আমার স্ত্রী ও আরেক ছেলে অনেক কষ্ট করে বের হয়েছে। আমি জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। আগুনে আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি।

আশরাফুল আরও বলেন, আগুনে আমার পাসপোর্ট, টিকিট, নগদ ৫০ হাজার টাকা এবং লাগেজ ট্রেনের ভেতরেই ছিল। পুড়ে গেছে। কিছুই বাঁচাতে পারিনি। বিদেশযাত্রা বাতিল হলেও পরিবারকে রক্ষা করতে পেরেছি।

লালমাটিয়া গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক এস এম জয় জানান, তিনি স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতা থেকে আসছিলেন। তারাও ‘ছ’ বগিতে ছিলেন। ট্রেনটি সায়েদাবাদ ছাড়ার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ থেমে যায়। তারা ভেবেছিলাম স্টেশনে পৌঁছেছেন। কিন্তু হঠাৎ আগুন দেখে ভয় পেয়ে যান। সমস্ত লাগেজ রেখে ট্রেন থেকে লাফ দেন তারা।

কুষ্টিয়ার পোড়াদহ থেকে ঢাকায় আসছিলেন তানিয়া। হঠাৎ ট্রেনটিতে আগুন লেগে গেলে দুই মেয়েকে নিয়ে ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেন তিনি। ঘটনাস্থলে যখন তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখনো ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব ছিলেন তিনি।

তানিয়া বলেন, সবাই বলছিল যে, এটা গ্যাস থেকে শুরু হয়েছে। হৈচৈ হচ্ছিল। কেউ চেইন টেনে ট্রেন থামিয়ে দিলো। আমি দুই মেয়েসহ ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিলাম।

‘আমার ছেলে আসিফ তার স্ত্রী নাতাশাকে নিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকায় আত্মীয়র বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার পথে ঘটনার শিকার হয়। আগুন লাগার পর দরজা দিয়ে বের হতে না পেরে আসিফ জানালা দিয়ে মাথা বের করে। সে সময়ে লোকজন তাকে টেনে বের করতে পারলেও তার স্ত্রী নাতাশা বের হতে পারেনি। ধারণা করা হচ্ছে, নাতাশা ট্রেনেই রয়ে গেছে। আমরা এখনো নাতাশাকে খুঁজে পাইনি।’

হতাশাভরা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আবু সিদ্দিক খান। শোকগ্রস্ত এই বাবা জানান, গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডে তার ছেলে আসিফ খান (৩০) দগ্ধ হয়েছেন। নিখোঁজ পুত্রবধূর নাম নাতাশা জেসমিন। তাদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় এবং বর্তমানে রাজধানীর গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা।

শুক্রবার রাত ১০টার দিকে দগ্ধ অবস্থায় আসিফকে উদ্ধার করে শেখ হাসিনার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. তরিকুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ট্রেনে দগ্ধ একজন আমাদের জরুরি বিভাগে এসেছেন। তার শরীরের আট শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। জরুরি বিভাগে তার চিকিৎসা চলছে।

বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুনের ঘটনায় নিহত চারজনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। চার মরদেহের মধ্যে একজন নারী ও একজন শিশু। বাকি দুজনের মরদেহ এতটাই বিকৃত হয়ে গেছে যে শনাক্ত করা যায়নি। স্বজনরা তাদের পরিজন দাবি করলেও মরদেহ দেখে শনাক্ত করতে পারছেন না।

ঢাকা রেলওয়ে থানার (কমলাপুর) উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. সেতাফুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘চারটি মরদেহের মধ্যে দুজন নারী ও শিশু। বাকি দুজন নারী না পুরুষ বোঝা যাচ্ছে না। নাতাশা জেসমিন (২৫) ও এলিনা ইয়াসমিন (৩০) নামে দুই নারীর মরদেহ দাবি করে তাদের স্বজনরা এসেছেন। তারা মরদেহ দেখেও শনাক্ত করতে পারেননি। ডিএনএ টেস্ট করে শনাক্ত করা হবে।’