জামিন নিয়ে লাপাত্তা ২৭২ জঙ্গি
- পোষ্ট হয়েছে : ১১:২৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ নভেম্বর ২০২২
- / ১০ বার দেখা হয়েছে
প্রথমবার্তা, প্রতিবেদক: পুরান ঢাকার আদালত এলাকা থেকে দুর্ধর্ষ দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে জামিনে থাকা এক জঙ্গিই ভয়ংকর ওই ঘটনার নেতৃত্ব দেয়। জামিনে থেকেই সে সহযোগী জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে। শুধু তাই নয়, সংশোধনের জন্য অনেক জঙ্গি জামিন পেলেও তারা ফের জড়িয়ে যাচ্ছে উগ্রবাদে। তবে গ্রেপ্তার জঙ্গিদের মধ্য থেকে এই জামিনের হার শতকরা ৪৯ দশমিক ৭৩ ভাগ। জামিন পাওয়া এই জঙ্গিদের মধ্যে অন্তত ২৭২ জন লাপাত্তা। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে যুক্ত পুলিশের সংস্থাগুলোর ধারণা, লাপাত্তা হওয়া এই জঙ্গিরা ফের জড়িয়েছে উগ্রবাদে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এরা উদ্বেগের কারণ।
১৯৯৪ সাল থেকে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত জঙ্গি মামলার পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, ওই ২৮ বছরে দেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত বিভিন্ন জঙ্গি ও উগ্রবাদী সংগঠনের ৪ হাজার ৯৯৮ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের মধ্যে ২ হাজার ৫১২ জন বিভিন্ন সময়ে আদালত থেকে জামিন পায়। এই ব্যক্তিদের মধ্যে ২৭২ জন জামিন নিয়ে আর আদালতে হাজিরা দিচ্ছে না। গ্রেপ্তার হওয়া অন্য জঙ্গিদের মধ্যে কয়েকজনের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে এবং কয়েকজন মারা গেছে। পুলিশ এই তালিকা তৈরি করেছে।
পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৯৯৪ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত জঙ্গি কার্যক্রম সংক্রান্তে দেশের বিভিন্ন থানায় ১৮টি মামলায় ১১৭ জঙ্গি ও উগ্রবাদীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই ১০ বছর পর্যন্ত ১১৭ আসামির মধ্যে ৫৬ জন জামিন পায়। তাদের মধ্যে জামিন নিয়ে পালিয়ে যায় ২১ জন। পরের বছর ২০১টি মামলায় গ্রেপ্তার হয় ১ হাজার ৯৯ জঙ্গি। তাদের মধ্যে ২০৩ জন জামিন পেলেও এদের মধ্য থেকে ৪১ জন লাপাত্তা হয়। ২০০৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৮ বছরে ৩২৮ মামলায় গ্রেপ্তার হয় ১ হাজার ১৪৮ জঙ্গি, তাদের মধ্যে জামিন মেলে ৯১৭ জনের। এই জামিন পাওয়া জঙ্গিদের ৪৫ জন লাপাত্তা হয়। ২০১৪ থেকে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৮ বছরে সবচেয়ে জঙ্গিবাদ সংক্রান্তে বেশি মামলা ও গ্রেপ্তার হয়। পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, ওই ৮ বছরে দেশের বিভিন্ন থানায় ৭৯৫টি মামলায় গ্রেপ্তার হয় ২ হাজার ৬৩৪ জঙ্গি। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৩৩৬ জন জামিন পেয়ে ১৫০ জনই লাপাত্তা হয়।
আইনজীবীরা বলছেন, জঙ্গিদের জামিন এবং খালাসের অন্যতম কারণ পুলিশের ভুল তদন্ত, ভুল এজাহার ও চার্জশিট এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারা।
কোনো জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করলে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। ওই আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো. গোলাম ছারোয়ার খান জাকির কালবেলাকে বলেন, অনেক সময় পুলিশ জঙ্গিদের আটক করে আদালতে হাজির করে জানায় যে, ওই জঙ্গির কাছ থেকে উগ্রবাদী ও জিহাদি বই উদ্ধার করা হয়েছে। মোবাইল ফোন বা ডিভাসে নাশকতার অনেক আলামত মিলেছে। কিন্তু আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তখন আদালতে বলেন, জব্দ করা বই তো নিষিদ্ধ নয়। তা ছাড়া মোবাইল ফোনের ফরেনসিক প্রতিবেদনও তখন পাওয়া যায় না। তখন চেষ্টা করেও ওই আসামিকে আটক করা কষ্টকর হয়। তার জামিন হয়ে যায়।
গ্রেপ্তার জঙ্গিদের অর্ধেকের বেশিই জামিন পাওয়ার বিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক কালবেলাকে বলেন, জঙ্গি গ্রেপ্তারের পর সব তথ্য-উপাত্তসহ তাকে আদালতে হাজির করা হয়। এর পরও জামিনের বিষয়টি একান্তই আদালতের এখতিয়ার। গ্রেপ্তারকারী সংস্থা পুলিশের কিছু করার থাকে না। এ ক্ষেত্রে শুধু বিব্রত হতে হয়।
তিনি বলেন, একজন জঙ্গি জামিন পেলে নিরাপত্তায় বড় বিঘ্ন ঘটতে পারে। এরা ফের জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়ে, সে উদাহরণ অনেক রয়েছে। এটা সবার বোঝা উচিত।
পুলিশের ভুল তদন্ত, ভুল এজাহার ও চার্জশিটের কারণে জঙ্গি মামলার আসামিদের খালাসের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সাবেক আইজিপি শহীদুল হক বলেন, পুলিশ তো আর জঙ্গিদের সঙ্গে খাতির করে না। সেখানে ইচ্ছা করে ভুলের কিছু নেই। কিন্তু অনেকেই তাদের মুক্ত করতে উঠেপড়ে লাগে। এর পরও পুলিশের কিছু ভুল থাকলে সেগুলোও সমাধানের সুযোগ রয়েছে।
মামলা তদন্তের হালচাল
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, জঙ্গি ও উগ্রবাদ সংক্রান্ত মামলাগুলোর মধ্যে এখনো ২৭৩টি মামলার তদন্ত চলছে। এর মধ্যে ১৯৯৪ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দায়ের মামলাগুলোর মধ্যে দুটি মামলা এখনো তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে। ১৫টির অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও একটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। ২০০৫ সালের মামলার মধ্যে তিনটির এখনো তদন্ত চলছে। ১৮১ মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও ১৭টিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। পরের বছরে দায়ের ৪৭টি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। ২০০৭ সালের মামলাগুলোর মধ্যে ৬টির তদন্ত চললেও ১৮টি মামলায় অভিযোগপত্র এবং দুটি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দায়ের সব মামলার তদন্ত শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে দায়ের ৯৭টি মামলার মধ্যে ৯২টিতে অভিযোগপত্র এবং দুটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। তিনটি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। ২০১৬ সালের মামলাগুলোর মধ্যে এখনো ১০টি মামলার তদন্ত চলছে, পরের বছর দায়ের মামলার মধ্যে তদন্ত চলছে ১৪টির।
২০১৮ সালে ১০৩ মামলার ৬৭টির অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও ৩২ মামলা রয়েছে তদন্তে। ওই বছর চারটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ৬৯টি মামলার মধ্যে মাত্র ১৭টিতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ওই বছরের ৫২টি মামলার তদন্ত চলছে। ২০২০ সালের ৮৪ মামলার মধ্যে মাত্র একটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া গেছে। পরের বছরের আগস্ট পর্যন্ত দায়ের ৬৯ মামলার একটিরও তদন্ত শেষ হয়নি।
জঙ্গি মামলায় অর্ধেকের বেশি আসামি খালাস!
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দায়ের মামলাগুলোর মধ্যে যেসব মামলার রায় দেওয়া হয়েছে, তাতে অর্ধেকের বেশি আসামিই আদালত থেকে খালাস পেয়েছে। গত ২৮ বছরে জঙ্গি সংক্রান্ত মামলার রায়ে আদালত থেকে ৫১ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়। ৫২৮ জনের যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হলেও খালাস পেয়ে যায় ৫৯৭ আসামি। এর মধ্যে ২০০৫ সালের মামলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড হয় এবং জঙ্গি খালাসও হয় ওই বছরই বেশি। ওই বছর ৪০ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হলেও ৪১০ জন খালাস পায়, সাজা হয় ৩৩৬ জনের। পরের বছরের মামলায় ৬৭ জনের সাজা হলেও খালাস পায় ২২ জন, ২০০৭ সালে ২৭ জঙ্গির সাজা হলেও খালাস পায় ২৬ জন। ২০০৮ সালে ৩১ জঙ্গির সাজা হলেও খালাস পায় ৫৮ জন। ২০০৯ সালে ২৬ জনের সাজা হলেও ১৮ জন খালাস পায়। ২০১০ ও ২০১১ সালে কয়েকটি মামলার রায়ে ২১ আসামির খালাস হলেও সাজা হয়নি কারও। ২০১২ সালে চারজনের সাজা হলেও খালাস পায় ১৩ জন। পরের তিন বছর ২৪ জনের খালাস হলেও সাজা পায়নি কেউ। ২০১৬ সালের মামলায় দুই জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড হয়, ২৫ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হলেও খালাস পায় ৩ জন। ২০১৭ সালের একটি মামলায় একজনের সাজা হয়। পরের চার বছরে দায়ের কোনো মামলার রায় হয়নি বলে পরিসংখ্যানে উঠে আসে।
সাজার চেয়ে খালাস বেশি হওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গোলাম ছারোয়ার খান জাকির বলেন, মামলার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর। আসামির স্বীকারোক্তি ও জবানবন্দি না থাকলে, প্রয়োজনীয় আলামত না থাকলে, প্রয়োজনীয় সাক্ষী না পেলে এবং সাক্ষীরা সঠিক সাক্ষ্য না দিলে তো আসামিপক্ষের আইনজীবী সেই সুযোগ নেবেন। এজন্যই আসামি খালাস হয়ে যাচ্ছে। তবে পুলিশের সঠিক তদন্ত এবং রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশনের দায়িত্ব পালনের কারণে অনেক বড় বড় ঘটনায় জঙ্গিদের সর্বোচ্চ শাস্তির নজির রয়েছে।