৪৩ হাজার কোটি টাকা তারল্য কমেছে পাঁচ মাসে
- পোষ্ট হয়েছে : ১২:৩৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৩
- / ৩৬ বার দেখা হয়েছে
প্রথমবার্তা, প্রতিবেদক: ব্যাংকিং খাতে তারল্য বাড়ানোর বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েও বাড়ানো যাচ্ছে না। উলটো তারল্য কমে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তারল্য কমেছে ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর আগে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কমেছিল ২৭ হাজার কোটি টাকা। অক্টোবরে তারল্য কিছুটা বাড়লেও নভেম্বরে আবার কমে যায়। শুধু নভেম্বরে তারল্য কমেছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। তবে ডিসেম্বরের সাময়িক হিসাবে তারল্য কিছুটা বেড়েছে।
সূত্র জানায়, ব্যাংকে গ্রাহকদের আমানত রাখার হার কমে গেছে। আমানত বাড়ার হার কমলেও বেড়েছে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ। ডলার সংকটের কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো টাকা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার কিনছে। এতেও মোটা অঙ্কের টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে চলে যাচ্ছে। এছাড়া পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ব্যাংকে মানুষ নতুন সঞ্চয় করা কমিয়ে দিয়েছে। এসব কারণে ব্যাংকিং খাতে তারল্য কমছে।
এদিকে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে বিশেষ তারল্য সহায়তার আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত এক সপ্তাহে প্রায় ৩৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা জোগান দেওয়া হয়েছে। এর বিপরীতে আবার কয়েকটি ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্যের কারণে বাজার থেকে ৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। এগুলো থেকে সরকারকে ঋণের জোগান দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো টাকা দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তা কিনছে। এ খাতে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ২৩ জানুয়ারি প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে চলে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে। যে কারণে তারল্য সংকট আরও বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, তারল্য ব্যবস্থাপনার আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে টাকা যেমন তুলে নেয়, তেমনই চাহিদা অনুযায়ী টাকার জোগানও দেয়। এটি একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। তবে ডলার সংকটের কারণে অনেক ব্যাংক ডলার কিনে টাকার সংকটে পড়ছে। তাদের বিশেষ তারল্য সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ওইসব ব্যাংকের যেসব অর্থ বিভিন্ন বন্ড বা ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ করা আছে, সেগুলো রেখে টাকা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, তারল্য সংকট ব্যবস্থাপনা আরও আধুনিকায়ন হচ্ছে। ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী ট্রেজারি বিল বা বন্ড বিক্রি করে সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট থেকেই টাকা তুলতে পারবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আর আসতে হবে না। এজন্য বন্ড মার্কেটকে শক্তিশালী করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের জুনে ব্যাংকিং খাতে মোট তারল্য ছিল ৪ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। গত নভেম্বরে তা কমে এসেছে ৩ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকায়। পাঁচ মাসে তারল্য কমেছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। এর আগে প্রায় সময়ই তারল্য বেড়েছে। অতীতে কখনোই তারল্য এত বেশি হারে কমেনি। তবে ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোকে আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হওয়ায় সাময়িকভাবে তারল্য কিছুটা বেড়েছে। জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মধ্য জানুয়ারি পর্যন্ত তারল্য আবার কিছুটা কমেছে।
আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় এবং ব্যাংকের ঝুঁকি কমাতে মোট আমানতের একটি অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ জমা হিসাবে রাখতে হয়। এর মধ্যে সাধারণ ব্যাংকগুলোকে রাখতে হয় মোট আমানতের ১৭ শতাংশ। ইসলামি ব্যাংকগুলোকে রাখতে হয় মোট আমানতের প্রায় ১০ শতাংশ। এ হিসাবে ব্যাংকগুলোর রাখার কথা ২ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকগুলোর রয়েছে ৩ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। এ খাতে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। অতিরিক্ত তারল্য এর আগে আড়াই লাখ কোটি টাকায় উঠেছিল। গত এক বছরে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, তারল্য ব্যবস্থাপনার আওতায় বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে যেমন টাকা তুলে নেয়, তেমনই প্রয়োজনবোধে ব্যাংকগুলোকে টাকার জোগান দেয়।
গত এক সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যি ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী বিশেষ তারল্য সহায়তার আওতায় ৩৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকার জোগান দিয়েছে। কয়েকটি ব্যাংকে বাড়তি তারল্য থাকায় একই সময়ে বাজার থেকে প্রায় ৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। এ অর্থ থেকে সরকারকে ঋণের জোগান দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে এক দিনেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। বাকি অর্থ ব্যাংকগুলোর কাছেই রয়েছে। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা জানান, এতে এটিই প্রমাণিত হচ্ছে-কিছু ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত বছরের জুলাই থেকে নভেম্বরে ব্যাংকে আমানত বেড়েছিল ৪৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের একই সময়ে বেড়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে আমানত ২৭ হাজার কোটি টাকা কম বেড়েছে। এর কারণ হিসাবে সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কমে গেছে, অন্যদিকে আমানতের সুদের হারের চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। এতে ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে বাড়ার পরিবর্তে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক মন্দায় মানুষের আয় কমার কারণে ব্যাংকে মানুষ সঞ্চয় করতে পারছে না। উলটো আগের সঞ্চয় থেকে অর্থ তুলে নিচ্ছে। এসব কারণে ব্যাংকে আমানত কমছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বছরের মে থেকে ব্যাংকে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোকে এলসির দায় মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নগদ টাকা দিয়ে ডলার কিনতে হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে গত ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ৮৪৮ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। এ বাবদ প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে বিক্রি করেছিল ৭৬২ কোটি ডলার। এ বাবদ গড়ে ৭০ হাজার কোটি টাকা চলে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। ব্যাংকে তারল্য কমার এটিও একটি কারণ। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে প্রায় ৮০০ কোটি ডলার কিনে নিয়েছে। ওই সময়ে বাজারে ডলারের প্রবাহ বেশি ছিল।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ব্যাংক খাতে আমানত বাড়ার হার কমলেও ঋণ বিতরণ বেড়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে ঋণ বিতরণ বেড়েছিল ৭৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ৮৭ হাজার কোটি টাকা।