ঢাকা , শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আরও কঠোর আন্দোলন তফশিল হলে

  • পোষ্ট হয়েছে : ০৪:০২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৩
  • / ৫১ বার দেখা হয়েছে

প্রথমবার্তা, প্রতিবেদক: একদফার দাবি উপেক্ষা করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করা হলে চলমান আন্দোলনের তীব্রতা বাড়াবে বিএনপি। দেওয়া হবে লাগাতার আরও কঠোর কর্মসূচি। হরতাল-অবরোধের মধ্যেই নির্বাচন কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ ভবন ঘেরাও এবং অবস্থান কর্মসূচির কথা ভাবছে দলটি। এ লক্ষ্যে কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে তিন দিন ধরে ভার্চুয়ালে যুক্ত হয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে হাইকমান্ড। বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

 

অন্যদিকে তফশিল ঘোষণা হলে একই কর্মসূচি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। একই পথে যাবে জামায়াতে ইসলামীও। এছাড়া কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট ও চরমোনাই পিরের দল ইসলামী আন্দোলনসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল।

 

বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোটের শীর্ষ নেতারা জানান, গত শুক্রবার ভারত আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের ‘টু-প্লাস-টু’ বৈঠকের পর বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন ও গণতন্ত্রের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান ফের স্পষ্ট করেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ গণতান্ত্রিক বিশ্ব। বিবদমান সব পক্ষকে শর্তহীন সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। তাই ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’ ছাড়া একতরফা তফশিল ঘোষণা করলে তা হবে ‘আত্মঘাতী’ সিদ্ধান্ত। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তা মেনে নেবে না।

 

নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্র জানিয়েছে, আজ বিকাল ৫টায় কমিশনের বৈঠক রয়েছে। এরপর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে তফশিল ঘোষণা করতে পারেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু যুগান্তরকে বলেন, ‘আন্দোলন যেখানে গেছে, যেভাবে জনগণ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে, তাতে করে দিনে দিনে আন্দোলনের তীব্রতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়বে।’

 

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী যুগান্তরকে বলেন, ‘সরকার জনগণের দাবি উপেক্ষা করে একতরফা নির্বাচন করার জন্য আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে অবৈধভাবে তফশিল দেওয়ার পাঁয়তারা শুরু করেছে। কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ার করে দিতে চাই-এই তফশিল নাটক বন্ধ করুন। আগে পদত্যাগ করুন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ক্ষমতা ছেড়ে দিন। এই দলদাস আওয়ামী নির্বাচন কমিশন বাতিল করুন। তারপর তফশিল। দাবি না মানলে পরিণতি হবে ভয়ংকর। এই তফশিলে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না। জনগণ কোনো ধরনের পাতানো প্রহসনের নির্বাচন বাংলাদেশের মাটিতে হতে দেবে না। এর বিরুদ্ধে লাগাতার কর্মসূচি দেওয়া হবে। বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’

 

এদিকে তিন দিন ধরে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের পাশাপাশি সমমনা দলগুলোর শীর্ষ নেতাদেরও মতামত নিয়েছে হাইকমান্ড। নেতাদের বিশ্লেষণ হচ্ছে, তফশিল ঘোষণা করা হলেও লাগাতার কর্মসূচি দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করতে অবরোধই কার্যকর কর্মসূচি। জেলা পর্যায়ে মহাসড়কগুলোতে পিকেটিং বাড়াবে তারা। হরতাল-অবরোধের পাশাপাশি ঢাকাকেন্দ্রিক বিকল্প কর্মসূচিও দেবে।

 

অন্যদিকে সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারসহ একদফা দাবিতে চলমান আন্দোলনে থাকা বিএনপি আশাবাদী হয়ে উঠেছে। এর কারণ হিসাবে দলটির নেতারা বলছেন, দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মাঝে গণতান্ত্রিক বিশ্বের চাপ আরও বাড়বে। ফলে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো ‘বিতর্কিত’ নির্বাচন করা সরকারের জন্য কঠিন হবে। এই অবস্থায় আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ানো গেলে সরকারের পক্ষে তা মোকাবিলা করা কঠিন হবে বলে মনে করেন নেতারা।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৩১ অক্টোবর থেকে চার দফা অবরোধ কর্মসূচি করেছে বিএনপি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানেও কর্মসূচি বিষয়ে বৈঠকে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। তবে দলের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতাই এখনো রাজপথে না নামায় তাদের কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, প্রত্যাশা অনুযায়ী ছাত্রদলের বর্তমান ও সাবেক নেতারা রাজপথে অবরোধের সমর্থনে কর্মসূচি করছে। তবে অন্যান্য অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠন এবং বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা নেতাদের ভূমিকায় দলের নীতিনির্ধারকরা হতাশা প্রকাশ করেছেন।

 

দক্ষিণাঞ্চলের এক জেলার শীর্ষ নেতা বলেন, তফশিল ঘোষণা হলে দল থেকে যে কর্মসূচি দেবে, তা সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে পালন করতে হবে। কেউ যদি অনুপস্থিত থাকে তাহলে দ্রুতই নতুন কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হবে বলে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়েছে।

 

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানান, বিএনপিসহ বিরোধী অধিকাংশ দলই সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। তাই তফশিল ঘোষণা হওয়ার পরপরই বিরোধী দলের আন্দোলন দমানো ও নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতারের যে অভিযান চলছে, তাতে ইসির ভূমিকা কী হবে তা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন তারা। দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, তফশিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের কাজে হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখে নির্বাচন কমিশন।

 

তাই নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর তা বাতিল করার দাবি জানানো হবে। তখন আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা রাজপথে বের হয়ে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবেন। তখন নির্বাচন কমিশনের অধীনে থেকেও যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি আগের মতো বিরোধী দলের আন্দোলন দমানো ও নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করে তাহলে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল আরও সক্রিয় হতে পারে।

 

বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেন এমন একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর সরকার রুটিন ওয়ার্ক ছাড়া কিছু করতে পারবে না। তখন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সংবিধান গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে। ইসির আচরণও যদি সরকারের মতো হয় তাহলে প্রমাণ হবে একতরফা নির্বাচনের আয়োজনের সব ব্যবস্থা হচ্ছে। বিএনপি তখন তা সামনে নিয়ে আসবে।

 

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শরিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন এক বিবৃতিতে বলেন, নির্বাচনের আগে প্রচণ্ড শক্তি প্রয়োগে বিরোধী দলকে রাজনৈতিক মাঠ থেকে বিতাড়িত করা, অগণিত আটক-গ্রেফতার ও নিপীড়ন করে নীলনকশার অংশ হিসাবে একতরফা নির্বাচনের ঘোষণা হবে সংঘাত এবং রক্তপাতকে উসকে দেওয়া। এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। যা রাষ্ট্রকে বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে যাবে। তফশিল ঘোষণার পর সংঘাত-সংঘর্ষ ও রক্তপাতের সব দায়-দায়িত্ব সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে বহন করতে হবে।’ নৈরাজ্য ও বিপর্যয়কর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকারের ক্ষমতা ধরে রাখার নীলনকশার আয়োজনে নির্বাচনি তফশিল ঘোষণা থেকে নির্বাচন কমিশনকে বিরত থাকার আহ্বানও জানান।

 

অপরদিকে বিএনপি ও সমমনাদের বাইরেও বাম ও কয়েকটি ইসলামি দলও তফশিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দেশের সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসানের লক্ষ্যে অবিলম্বে সরকারকে পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য সংলাপ শুরুর আহ্বান জানিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। নেতারা বলেছেন, গণদাবি উপেক্ষা করে সরকার নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে একতরফা প্রহসনমূলক নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাম গণতান্ত্রিক জোট সারা দেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করবে। তফশিল ঘোষণার পরদিন থেকে কঠোর কর্মসূচি শুরু হবে।

 

আজ বিকাল ৩টায় নির্বাচন কমিশন অভিমুখে গণমিছিল করার ঘোষণা দিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। মঙ্গলবার বিকালে পল্টনস্থ কার্যালয়ে দেশের চলমান সংকটজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা সভায় দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল-মাদানী বলেন, আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া একতরফা তফশিল ঘোষণা হলে মঙ্গলবার (আজ) বিকাল ৩টায় বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে জমায়েত শেষে নির্বাচন কমিশন অভিমুখে গণমিছিল হবে। একতরফা তফশিল ঘোষণা দেশকে গৃহযুদ্ধের পথে নিয়ে যাবে। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া একটি দলের ইচ্ছা পূরণের তফশিল দেশবাসী মানবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় না নিয়ে সমঝোতাবিহীন তফশিল ঘোষণা হলে নতুন করে দেশে সংকট তৈরি হবে এবং দেশ নিশ্চিত গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হবে।

 

আজ থেকে ফের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ : এদিকে পঞ্চম দফায় আজ ভোর ৬টা থেকে ফের শুরু হচ্ছে দেশব্যাপী সড়ক-রেল-নৌপথ ও রাজপথসহ সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি। যা শুক্রবার ভোর ৬টায় শেষ হবে। বিএনপির পাশাপাশি একই কর্মসূচি পালন করবে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা দল ও জোট। যুগপৎ আন্দোলনে না থাকলেও পৃথকভাবে একই কর্মসূচি পালন করবে জামায়াতে ইসলামী। কর্মসূচি সফলে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে দলগুলো।

ট্যাগ :

শেয়ার দিয়ে সাথেই থাকুন

আরও কঠোর আন্দোলন তফশিল হলে

পোষ্ট হয়েছে : ০৪:০২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৩

প্রথমবার্তা, প্রতিবেদক: একদফার দাবি উপেক্ষা করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করা হলে চলমান আন্দোলনের তীব্রতা বাড়াবে বিএনপি। দেওয়া হবে লাগাতার আরও কঠোর কর্মসূচি। হরতাল-অবরোধের মধ্যেই নির্বাচন কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ ভবন ঘেরাও এবং অবস্থান কর্মসূচির কথা ভাবছে দলটি। এ লক্ষ্যে কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে তিন দিন ধরে ভার্চুয়ালে যুক্ত হয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে হাইকমান্ড। বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

 

অন্যদিকে তফশিল ঘোষণা হলে একই কর্মসূচি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। একই পথে যাবে জামায়াতে ইসলামীও। এছাড়া কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট ও চরমোনাই পিরের দল ইসলামী আন্দোলনসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল।

 

বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোটের শীর্ষ নেতারা জানান, গত শুক্রবার ভারত আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের ‘টু-প্লাস-টু’ বৈঠকের পর বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন ও গণতন্ত্রের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান ফের স্পষ্ট করেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ গণতান্ত্রিক বিশ্ব। বিবদমান সব পক্ষকে শর্তহীন সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। তাই ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’ ছাড়া একতরফা তফশিল ঘোষণা করলে তা হবে ‘আত্মঘাতী’ সিদ্ধান্ত। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তা মেনে নেবে না।

 

নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্র জানিয়েছে, আজ বিকাল ৫টায় কমিশনের বৈঠক রয়েছে। এরপর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে তফশিল ঘোষণা করতে পারেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু যুগান্তরকে বলেন, ‘আন্দোলন যেখানে গেছে, যেভাবে জনগণ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে, তাতে করে দিনে দিনে আন্দোলনের তীব্রতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়বে।’

 

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী যুগান্তরকে বলেন, ‘সরকার জনগণের দাবি উপেক্ষা করে একতরফা নির্বাচন করার জন্য আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে অবৈধভাবে তফশিল দেওয়ার পাঁয়তারা শুরু করেছে। কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ার করে দিতে চাই-এই তফশিল নাটক বন্ধ করুন। আগে পদত্যাগ করুন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ক্ষমতা ছেড়ে দিন। এই দলদাস আওয়ামী নির্বাচন কমিশন বাতিল করুন। তারপর তফশিল। দাবি না মানলে পরিণতি হবে ভয়ংকর। এই তফশিলে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না। জনগণ কোনো ধরনের পাতানো প্রহসনের নির্বাচন বাংলাদেশের মাটিতে হতে দেবে না। এর বিরুদ্ধে লাগাতার কর্মসূচি দেওয়া হবে। বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’

 

এদিকে তিন দিন ধরে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের পাশাপাশি সমমনা দলগুলোর শীর্ষ নেতাদেরও মতামত নিয়েছে হাইকমান্ড। নেতাদের বিশ্লেষণ হচ্ছে, তফশিল ঘোষণা করা হলেও লাগাতার কর্মসূচি দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করতে অবরোধই কার্যকর কর্মসূচি। জেলা পর্যায়ে মহাসড়কগুলোতে পিকেটিং বাড়াবে তারা। হরতাল-অবরোধের পাশাপাশি ঢাকাকেন্দ্রিক বিকল্প কর্মসূচিও দেবে।

 

অন্যদিকে সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারসহ একদফা দাবিতে চলমান আন্দোলনে থাকা বিএনপি আশাবাদী হয়ে উঠেছে। এর কারণ হিসাবে দলটির নেতারা বলছেন, দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মাঝে গণতান্ত্রিক বিশ্বের চাপ আরও বাড়বে। ফলে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো ‘বিতর্কিত’ নির্বাচন করা সরকারের জন্য কঠিন হবে। এই অবস্থায় আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ানো গেলে সরকারের পক্ষে তা মোকাবিলা করা কঠিন হবে বলে মনে করেন নেতারা।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৩১ অক্টোবর থেকে চার দফা অবরোধ কর্মসূচি করেছে বিএনপি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানেও কর্মসূচি বিষয়ে বৈঠকে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। তবে দলের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতাই এখনো রাজপথে না নামায় তাদের কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, প্রত্যাশা অনুযায়ী ছাত্রদলের বর্তমান ও সাবেক নেতারা রাজপথে অবরোধের সমর্থনে কর্মসূচি করছে। তবে অন্যান্য অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠন এবং বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা নেতাদের ভূমিকায় দলের নীতিনির্ধারকরা হতাশা প্রকাশ করেছেন।

 

দক্ষিণাঞ্চলের এক জেলার শীর্ষ নেতা বলেন, তফশিল ঘোষণা হলে দল থেকে যে কর্মসূচি দেবে, তা সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে পালন করতে হবে। কেউ যদি অনুপস্থিত থাকে তাহলে দ্রুতই নতুন কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হবে বলে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়েছে।

 

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানান, বিএনপিসহ বিরোধী অধিকাংশ দলই সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। তাই তফশিল ঘোষণা হওয়ার পরপরই বিরোধী দলের আন্দোলন দমানো ও নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতারের যে অভিযান চলছে, তাতে ইসির ভূমিকা কী হবে তা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন তারা। দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, তফশিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের কাজে হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখে নির্বাচন কমিশন।

 

তাই নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর তা বাতিল করার দাবি জানানো হবে। তখন আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা রাজপথে বের হয়ে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবেন। তখন নির্বাচন কমিশনের অধীনে থেকেও যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি আগের মতো বিরোধী দলের আন্দোলন দমানো ও নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করে তাহলে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল আরও সক্রিয় হতে পারে।

 

বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেন এমন একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর সরকার রুটিন ওয়ার্ক ছাড়া কিছু করতে পারবে না। তখন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সংবিধান গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে। ইসির আচরণও যদি সরকারের মতো হয় তাহলে প্রমাণ হবে একতরফা নির্বাচনের আয়োজনের সব ব্যবস্থা হচ্ছে। বিএনপি তখন তা সামনে নিয়ে আসবে।

 

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শরিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন এক বিবৃতিতে বলেন, নির্বাচনের আগে প্রচণ্ড শক্তি প্রয়োগে বিরোধী দলকে রাজনৈতিক মাঠ থেকে বিতাড়িত করা, অগণিত আটক-গ্রেফতার ও নিপীড়ন করে নীলনকশার অংশ হিসাবে একতরফা নির্বাচনের ঘোষণা হবে সংঘাত এবং রক্তপাতকে উসকে দেওয়া। এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। যা রাষ্ট্রকে বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে যাবে। তফশিল ঘোষণার পর সংঘাত-সংঘর্ষ ও রক্তপাতের সব দায়-দায়িত্ব সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে বহন করতে হবে।’ নৈরাজ্য ও বিপর্যয়কর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকারের ক্ষমতা ধরে রাখার নীলনকশার আয়োজনে নির্বাচনি তফশিল ঘোষণা থেকে নির্বাচন কমিশনকে বিরত থাকার আহ্বানও জানান।

 

অপরদিকে বিএনপি ও সমমনাদের বাইরেও বাম ও কয়েকটি ইসলামি দলও তফশিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দেশের সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসানের লক্ষ্যে অবিলম্বে সরকারকে পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য সংলাপ শুরুর আহ্বান জানিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। নেতারা বলেছেন, গণদাবি উপেক্ষা করে সরকার নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে একতরফা প্রহসনমূলক নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাম গণতান্ত্রিক জোট সারা দেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করবে। তফশিল ঘোষণার পরদিন থেকে কঠোর কর্মসূচি শুরু হবে।

 

আজ বিকাল ৩টায় নির্বাচন কমিশন অভিমুখে গণমিছিল করার ঘোষণা দিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। মঙ্গলবার বিকালে পল্টনস্থ কার্যালয়ে দেশের চলমান সংকটজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা সভায় দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল-মাদানী বলেন, আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া একতরফা তফশিল ঘোষণা হলে মঙ্গলবার (আজ) বিকাল ৩টায় বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে জমায়েত শেষে নির্বাচন কমিশন অভিমুখে গণমিছিল হবে। একতরফা তফশিল ঘোষণা দেশকে গৃহযুদ্ধের পথে নিয়ে যাবে। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া একটি দলের ইচ্ছা পূরণের তফশিল দেশবাসী মানবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় না নিয়ে সমঝোতাবিহীন তফশিল ঘোষণা হলে নতুন করে দেশে সংকট তৈরি হবে এবং দেশ নিশ্চিত গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হবে।

 

আজ থেকে ফের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ : এদিকে পঞ্চম দফায় আজ ভোর ৬টা থেকে ফের শুরু হচ্ছে দেশব্যাপী সড়ক-রেল-নৌপথ ও রাজপথসহ সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি। যা শুক্রবার ভোর ৬টায় শেষ হবে। বিএনপির পাশাপাশি একই কর্মসূচি পালন করবে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা দল ও জোট। যুগপৎ আন্দোলনে না থাকলেও পৃথকভাবে একই কর্মসূচি পালন করবে জামায়াতে ইসলামী। কর্মসূচি সফলে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে দলগুলো।