প্রথমবার্তা, প্রতিবেদক: সুন্দরবন-সংলগ্ন খুলনার কয়রা উপজেলার তিন ইউনিয়নে আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায়ের বসবাস। বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে এ এলাকায় বসবাস শুরু করেন তাদের পূর্বপুরুষরা। এক সময় প্রায় সব মুন্ডা পরিবারের পর্যাপ্ত জমি ছিল। কালক্রমে প্রভাবশালীরা ছলচাতুরি করে সেসব জমি দখলে নিয়েছে। অনেকে অভাবে পড়েও জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।

 

ফলে অধিকাংশ মুন্ডা পরিবারই এখন ভূমিহীন অথবা শুধু মাথা গোঁজার বসতির অধিকারী। এক পুরুষ আগেও যাদের কয়েক বিঘা জমি ছিল, এখন তাদের আছে শুধুই ভিটে। অন্যের ক্ষেতে চাষ করে কিংবা দিনমজুরি করে কোনোমতে সংসার চলে। কালের বিবর্তনে সম্পত্তি বেহাত হয়ে নিজ আদিভূমিতে তারা এখন অন্যের প্রজা।

 

মুন্ডাদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ইনিশিয়েটিভ ফর রাইট ভিউ (আইআরভি) নামের একটি এনজিও সংস্থা। এর নির্বাহী পরিচালক মেরিনা যুথী বলেন, প্রায় আড়াইশ বছর আগে ভারতের ঝাড়খণ্ড এলাকা থেকে মুন্ডাদের এ অঞ্চলে আনা হয়। সুন্দরবন কেটে আবাসভূমি গড়ে তোলার কাজে নিযুক্ত করা হয় তাদের। বর্তমানে কয়রায় মুন্ডাদের ৩২০টি পরিবারের জনসংখ্যা এক হাজার ৫৩০ জন।

 

এসব পরিবারের ৯৫ শতাংশ ভূমিহীন। অশিক্ষা, অজ্ঞতা ও অভাবকে পুঁজি করে ভূমিদস্যুরা তাদের সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছে। মুন্ডাদের প্রধান সমস্যাগুলো হলো- খাদ্য, জীবিকা, সুপেয় পানি ও শিক্ষার অভাব। মুন্ডারা কৃষিকাজে অভ্যস্ত- এ কথা জানিয়ে তিনি আরো বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সে সুযোগ কমে আসছে।

 

এজন্য এখন প্রয়োজন টেকসই বিকল্প জীবিকার খোঁজ। কয়রা উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার পিচঢালা পথ পেরোলেই টেপাখালী গ্রাম। গ্রামটির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শাকবাড়িয়া নদী পার হলেই সুন্দরবন।

 

টেপাখালী গ্রামে মুন্ডা সম্প্রদায়ের ৪৫টি পরিবারের ২০৯ জনের বসবাস। তাদের বেশিরভাগই ভূমিহীন। চরের জমিতে ঘর তুলে বাস করেন তারা। আবার দু-একটি পরিবারের ভিটেবাড়ি থাকলেও ফসলি জমি নেই। তাই সংসার চালাতে পরিবারের নারী-পুরুষ সবাইকে দিনমজুরি করতে হয়।

 

টেপাখালী গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বিরিঞ্চি মুন্ডা বলেন, ‘তাদের ১২ বিঘা জমির সবই প্রভাবশালীরা ছলচাতুরি করে আত্মসাৎ করেছে। কয়রার প্রভাবশালী হাওলাদার বাড়ির লোকজন এক সের চাল আর দুই সের খুদ দিয়েও জমি নিয়েছে। এখন আর হাওলাদার বাড়িতে আমাদের ঢুকতে দেয় না। ওরা বলে, মুন্ডাদের জমি নিতে আবার টাকা লাগে নাকি!’

 

ওই এলাকার তারাপদ মুন্ডা বলেন, ‘অভাবের কারণে এক পালি (মাপার পাত্র বিশেষ) ধান নিলে মহাজন হাওলাদারদের পরে ফেরত দিতে হতো আড়াই পালি ধান। এভাবে ঋণের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে জমি দিয়ে শোধ করতে হতো মুন্ডাদের। ’ কয়রা সদরের নলপাড়া গ্রামের শতবর্ষী বৃদ্ধ দুর্গাপদ মুন্ডা বলেন, ‘এক সময় আমি ২২ বিঘা জমির মালিক ছিলাম।

 

এখন শুধু বসতঘর ছাড়া আর কিছু নেই। ’ অভাব-অনটনের কথা জনপ্রতিনিধিদের বললেও গুরুত্ব দেন না বলে অভিযোগ তার। কয়রা উপজেলার ৬ নম্বর কয়রা, ১ নম্বর কয়রা, মাঝের আইট, নলপাড়া, নোনাদিঘি, গাজীপাড়া, জোড়শিং, আংটিহারা, বতুল বাজার, কাটকাটাসহ কয়েকটি গ্রামে মুন্ডাদের নিবাস। জাতীয় আদিবাসী পরিষদ খুলনা জেলা শাখার সভাপতি তপন কুমার সরদার বলেন, ‘বাংলাদেশে বসবাসকারী মুন্ডারা একটি অবহেলিত জনগোষ্ঠী। প্রভাবশালীরা নানাভাবে তাদেরকে শোষণ করে আসছেন।

 

১৯৫০-এর রাষ্ট্রীয় প্রজাস্বত্ব আইনে আদিবাসী সম্প্রদায়ের জমি বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও নাম ও পদবী পরিবর্তন করে এদের দখলীয় সম্পত্তি ক্রয় দেখিয়ে দখল করে নিয়েছেন এলাকার প্রভাবশালী মহল। ’ সার্বিক অবস্থায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বেদখল জমির দখল ফিরে পেতে এবং তাদের জমি রক্ষায় সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।