প্রথমবার্তা, প্রতিবেদক: আন্তদেশীয় পাচারকারী চক্র বন্যপ্রাণী পাচারে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছে বাংলাদেশকে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর থেকে কংগ্রেসে পাঠানো এক প্রতিবেদনেও এ তথ্য উঠে এসেছে। মূলত পাশের দেশ ভারতে বন্যপ্রাণী পাচারসংশ্লিষ্ট কঠোর আইনের কারণে দেশটির পাচারকারীরা বাংলাদেশকে প্রাণী পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছেন।

বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের তথ্যে, গত এক দশকে দেশে পাচার ঠেকিয়ে প্রায় ৩৮ হাজার জীবন্ত বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী পাচারসংক্রান্ত অভিজ্ঞ আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ট্রাফিক’-এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ৫০০ কোটি টাকার বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ পাচার হয়।

সাধারণত সড়ক, নৌ ও আকাশ পথে বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী পাচার হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর অনেক বন্যপ্রাণী বৈধভাবে রপ্তানি করা হয়। আর বৈধভাবে পাঠানো এসব প্রাণীর সঙ্গে অবৈধভাবে কোনো প্রাণী পাচার হয়ে যাচ্ছে কি না সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। তাঁদের মতে, বন্যপ্রাণী পাচার রোধে প্রতিটি দেশের প্রতিটি বিমানবন্দর ও বিভাগীয় পর্যায়ে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট থাকা দরকার।

বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের দেওয়া তথ্যে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ৩ হাজার ২৬৬টি প্রাণী উদ্ধার করা হয়। আর পাচারের জন্য বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সময় উদ্ধারকৃত বন্যপ্রাণীগুলো হচ্ছে- বিভিন্ন ধরনের পাখি, শুশুক, মায়াহরিণ, বিভিন্ন ধরনের সাপ, বনবিড়াল, মেছোবিড়াল, হনুমান, গন্ধগোকুল, বেজি, বানর, তক্ষক, কচ্ছপ, রামগুঁই, ভোঁদড়, রাজকাঁকড়া, ঘড়িয়াল, বাঘাইড়, শিয়াল, চিতাবিড়াল, লজ্জাবতী বানর।

তবে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট কর্তৃপক্ষ জানান, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাচারের জন্য দেশের যেসব প্রাণী ঝুঁকিতে রয়েছে তার মধ্যে আছে- কচ্ছপ, বানরজাতীয় প্রাণী, তক্ষক, বনরুইজাতীয় প্রাণী। এর মধ্যে কচ্ছপ পাশের দেশে পাচার হয় আবার পাশের দেশ থেকেও বাংলাদেশে আসে।

সম্প্রতি বানরজাতীয় প্রাণীগুলোর সড়কপথে পাশের দেশে পাচারের ঘটনা বেশি ঘটছে। তবে আগের তুলনায় সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের পাচারের ঘটনা অনেকাংশে কমে এসেছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা ও কঠোর আইন কার্যকর ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া সুন্দরবনে দস্যুদের আনাগোনা কমে আসায় রয়েল বেঙ্গল টাইগারের পাচারের ঘটনা কমে আসার আরেকটি কারণ।

রাজধানী ঢাকা ও আশপাশ এলাকা ছাড়াও কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, চলনবিল, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে স্থানীয় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ও বাইরে পাচারের জন্য বন্যপ্রাণী শিকার করা হচ্ছে। বন বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানান, আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্র বিভিন্ন দেশ থেকে প্রথমে আকাশপথে বন্যপ্রাণী নিয়ে বাংলাদেশে আসে।

এরপর সড়কপথে এসব প্রাণী চলে যায় দেশের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকায়। তারপর ভারত হয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, চীন, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য দেশে প্রাণীগুলো পাচার করা হয়। জানা যায়, বন্যপ্রাণী চোরাচালানে একটি আন্তর্জাতিক চক্র সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।

কখনো এ চক্র দেশের ভিতর থেকে বিভিন্নভাবে প্রাণী পাচার করছে আবার কখনো তারা বাংলাদেশকে বন্যপ্রাণী পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। তবে বিভিন্ন সময় পাচারে জড়িত বন্যপ্রাণী বহনকারীদের আটক করা হলেও দেশি-বিদেশি মূল হোতারা রয়ে যায় অধরা।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বেনাপোল, হিলি ও বাংলাবান্ধা পোর্ট দিয়েই বেশি জীবন্ত বন্যপ্রাণী পাচার করা হয়। পাচারকারী চক্র মূলত বাংলাদেশে ঘুরতে আসা বিদেশি পর্যটক এবং দেশের ধনী-শৌখিন ক্রেতার কাছে এসব বন্যপ্রাণী বিক্রি করে। বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর ট্রফি পাচারের জন্য পাচারকারীরা নদীপথ ও আকাশপথ ব্যবহার করে।

মূলত বাংলাদেশের তিন দিকেই স্থলভাগ। আর দেশের স্থলভাগ সে অর্থে বন্যপ্রাণীর জন্য নিরাপদ নয়। এজন্য বাংলাদেশকে পাচারকারীরা সহজেই ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। ট্রাফিকের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়- ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে ৫১টি বাঘের চামড়া ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার হয়েছে। সংস্থাটির প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী পাচার চক্র যে বাংলাদেশকে ‘ট্রানজিট রুট’ হিসেবে ব্যবহার করে তা উঠে এসেছে।

বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক মো. ছানাউল্যা পাটওয়ারী বলেন, বাংলাদেশের তিন দিক দিয়েই ভারতের অবস্থান। দেশটির পাচারকারীরা তাদের কঠোর আইনের কারণে বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে।

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর অনেক বন্যপ্রাণী বৈধভাবে রপ্তানি করা হয়। আর বৈধভাবে পাঠানো এসব প্রাণীর সঙ্গে অবৈধভাবে কোনো প্রাণী পাচার হয়ে যাচ্ছে কি না তা একটি বড় প্রশ্ন। সাধারণত গভীর রাতে বিমানবন্দরে এসব প্রাণীর ওঠানামার সুযোগ কাজে লাগায় প্রাণী পাচারের সঙ্গে যুক্ত সিন্ডিকেট।

তিনি জানান, বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটটি বন বিভাগের আওতায় অনেকটা যৌথ বাহিনীর মতো কাজ করছে। বিভিন্ন ইউনিট থেকে জনবল নিয়ে এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রাণী পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে এমন সন্দেহভাজন মানুষ যেসব জেলায় আছে তার তালিকা তৈরি করে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট ইন্টারপোলকে জানিয়ে দেয়।

সেই তালিকা ইন্টারপোল বাংলাদেশ পুলিশকে পৌঁছে দেয়। এর মধ্যে কোনো ব্যক্তিকে পুলিশ বা বন বিভাগের সন্দেহ হলে তার মোবাইল ট্র্যাক করে তাকে চিহ্নিত করা হয়। তবে বাংলাদেশে সুনির্দিষ্টভাবে কতজন এ পাচার সিন্ডিকেটে জড়িত তা বের করা যায়নি। দেশে যারা এ অপরাধে জড়িত তার বেশির ভাগই ‘সাপোর্টিং বিজনেস’ হিসেবে এটি করে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়- আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় বন্যপ্রাণী পাচারের বিভিন্ন রুট আছে। বন্যপ্রাণী পাচারকারী চক্রগুলো বাংলাদেশকে বিশেষ করে ভারতে পাচার বা ভারত থেকে পাচারের জন্য পছন্দের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে।

বাংলাদেশকে ব্যবহার করে পাচার হওয়া প্রাণীগুলোর মধ্যে কচ্ছপ, পাখি, কুমির, বানর ও বনবিড়াল উল্লেখযোগ্য। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়- বন্যপ্রাণী পাচারে জড়িতদের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গে ইন্টারপোল নিবিড়ভাবে কাজ করছে। সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন